Travels Blog

চট্টগ্রাম সফর

August 22, 2025 · by xfactor@abdullahmuktadir.com

বাংলাদেশে ভ্রমণের সর্বোৎকৃষ্ট স্থানগুলোর অধিকাংশই চিটাগাংয়ে। চট্টগ্রাম বিভাগে ঘুরার জায়গার শেষ নেই। ছোট থেকে ঘুরাঘুরির প্রতি আগ্রহ থাকলেও পড়াশোনার চাপ ও আর্থিক সংকটে খুব বেশী ঘুরে বেড়ানো হয়নি। তারপরও যে কয়টা স্থানঘুরেছি তন্মধ্যে চিটাগাংয়ের খৈয়াছড়া সর্বপ্রথম। আমার ঘুরাঘুরি জীবনের প্রথম সফর সম্পর্কেই লিখব আজ—

ভোর ৪ টা বেজে ৩০ মিনিট। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। ব্যস্ত ঢাকা শহর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নীরব নিস্বব্ধ আমাদের মাদরাসার আঙ্গিনা। আমরা ১৪জন প্রস্তুতি নিচ্ছি সফরে বের হওয়ার। আবাসিক মাদরাসায় থাকার কারণে মাদরাসার দেয়াল টপকিয়ে বের হওয়াই ছিল আমাদের বাহিরের যাওয়ার একমাত্র পথ। বহু চড়াই উতরাই পাড় করে আমরা মাদরাসার বাহিরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি চলে আসলো। গাড়ির ড্রাইভার মামা আমাদের উপর কিছুটা নারাজ। আমরা যে হাইসভাড়া করেছিলাম সেটা ১২ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন কিন্তু আমরা যাচ্ছি ১৪জন ।

ঘুমন্ত নগরীর আঁকাবাকা রাস্তা পাড়ি দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। ভোরের ঢাকা খুবই চমৎকার। কোনো জ্যাম নেই, শব্দের কাঠিণ্যতা নেই। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দ্রুত গতিতেই ছুটছিলাম। কাঁচপুর ব্রীজের ওখানে গিয়ে থেমে গেল গাড়ির গতি, বাধা হয়ে সামনে এলো জ্যাম। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমরা জ্যাম থেকে মুক্তি পেলাম। জ্যাম থেকে মুক্ত হয়ে মনে মনে একটুখুশিই হয়েছিলাম যখন শুনলাম এরপর আর জ্যাম পাবো না।

কিন্তু আমাদের খুশি বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না—কিছুদূর যাওয়ার পর আবার জ্যাম শুরু। যত সামনে যাচ্ছিলাম ততোই যেন জ্যাম বাড়ছিল। জ্যামের মধ্যেই আমরা মুন্সিগন্জ পথের ধারে মসজিদ দেখে ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষ করে এসেও দেখলাম গাড়ি একটুও আগায়নি। তীব্র জ্যামে অতিষ্ট আমাদের সফর সঙ্গীরা। সফর সঙ্গী হিসেবে আমাদের হেদায়াতুন্নাহু জামাতের ১৪জনই ছিলাম।

সফরের পরিকল্পনা করার সময় আমাদের ধারণা ছিল ৪টার দিকে বের হয়ে সকাল ৮টার মধ্যে আমরা লোকেশনে পৌঁছে যাবো।কিন্তু সকাল ৮ঃ৩০মিনিট পর্যন্ত আমরা মুন্সিগন্জ জ্যামেই বসে ছিলাম।

দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে ১০ঃ৩০ মিনিটের দিকে আমরা কুমিল্লা নেমে সকালের নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা শেষ করে ফের রওনা হলাম চিটাগাংয়ের দিকে। এবার যেন জ্যাম দ্বিগুন হয়ে ফিরে এলো। গাড়ির নড়াচড়া নেই একটুও……

অবশেষে দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে দুপুর ২ঃ৩০ মিনিটের দিকে আমরা মীরসরাই পৌঁছলাম। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে শুরু হলো আমাদের খৈয়াছড়া ঝর্ণার দিকে যাত্রা। ধারণা করা হয় প্রায় ৫০ বছর আগে থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে খৈয়াছড়া ঝর্ণাটি। জনমানহীন পাহাড়ি এলাকা এবং ঝোপ ঝাড়ের আধিক্যের জন্য এটির অবস্থান আবিষ্কারে সময় লেগেছে অনেক। আবার অনেকে ধারণা করেন প্রায় ৫০ বছর আগে পাহাড়ি ঢলের ফলে এই ঝর্ণাটি তৈরি হয়েছে, এর পূর্বে এখানে ঝর্ণাটি ছিল না।

২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে কুণ্ডের হাট (বড়তাকিয়া) ব্লকের ২৯৩৩.৬১ হেক্টরর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবেঘোষণা করায় খৈয়াছড়া ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত হয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের “রামগড়-সীতাকুন্ড- রিজার্ভ ফরেস্টের” খৈয়াছড়া ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার অন্যতম মূল লক্ষ্য হল খৈয়াছড়া ঝর্ণার সংরক্ষণ।

ঝিরিপথ ধরে পাহাড়ের আঁকাবাকা রাস্তা অতিক্রম করে এগিয়ে চলছি। কিছু সময় হাঁটার পর চোখে পড়লো বিশাল বিশাল পাহাড়। উঁচু উঁচু বিশাল পাহাড়গুলো নাম না জানা হাজার রকম গাছে পূর্ণ। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসীম ক্ষমতা ও মহীমার কথা ভাবছিলাম।

আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি দেখতে দেখতে আমরা সামনে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো বিশাল বড় এক পাথর। এতোটাই বড় যে, পাথারের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অনেক ছোট দেখাচ্ছিলো। পাথর এতো বড় হতে পারে সেটা কখনো কল্পনাও করিনি।

কিছুদূর সামনে আগানোর পর আমরা একটা ঝর্ণা দেখতে পেলাম। ইচ্ছে ছিল সেটায় নেমে গোসল করবো কিন্তু সেখানে ছেলেমেয়ে অবাধে গোসল করছিল যা দেখে আর গোসলের ইচ্ছে হয়নি। আমরা আরো সামনে এগিয়ে গেলাম, কিছুদূর যেতে আরো একটি ঝর্ণা পেলাম। বলে রাখা ভালো খৈয়াছড়া ঝর্ণায় মোট ৯টি বড় ঝর্ণার ধাপ (তথা ক্যাসকেড) ও অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন ধাপ রয়েছে। মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নে ঝর্ণারটির অবস্থানের কারণে ঝর্ণাটির নামকরণ করা হয়েছে “খৈয়াছড়াঝর্ণা”। আমরা এগাতে এগাতে খৈয়াছড়া ঝর্ণার একেকটি ধাপ পাচ্ছিলাম। যার যার সুবিধা অনুযায়ী একেক ধাপে একেকজন গোসল করছিলো।

এভাবে ঘুরে ঘুরে আমরা মোটামুটি ৬-৭টা ধাপ পার করলাম। ঝর্ণার ঠান্ডা পানিতে গোসলের আয়োজন শেষ করে এক ফাঁকে পাহাড়েই যোহরের নামাজ পড়ে নিলাম।

নামাজ শেষে ফেরার ইচ্ছে নিয়ে পিছনের দিকে আসতে শুরু করেছি এমন সময় আব্দুল হামিদ ভাইয়ের ডাক। দূর থেকে আমারনাম ধরে জোরে জোরে ডাকছিলেন হামিদ ভাই। হামিদ ভাইকে দেখলাম উঁচু আরেকটা পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করছে। আমাকেও ওনার সঙ্গী হতে বললেন। আমার সাথে বাকী সফরসঙ্গীরাও যুক্ত হলো। সবাই মিলে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখতে পেলাম আরো একটি পাহাড়ের চূড়া। ওটায় উঠতে কেউ সাহস করলো না। কিন্তু আমি, রাশেদ ভাই আর রাকিব ৩জন সাহস করে উপরে উঠলাম। আমরা যেখানে উঠেছি সেটাই ছিল সর্বোচ্চ চূড়া। সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে আল্লাহর রাব্বুল আলামিনের প্রতি শুকরিয়া স্বরূপ২ রাকাত নামাজ আদায় করলাম।

এক ঝর্ণা থেকে আরেক ঝর্ণা এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। আমারও ফেরার পথ ধরলাম। ফিরতি পথে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় গরু দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের এতো চূড়ায় গরু দেখে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। যেখানে মানুষের উঠতে দম বের হয়ে যায় সেখানে এরকম গাছ পালার মধ্য দিয়ে গরু কিভাবে এতো উপরে আসে বুঝতে পারছিলাম না।

আমরা পাহাড়ে যাওয়ার সময় একটা হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। এখানের নিয়ম এমনই। বেশ কয়েক ঘন্টা আগে অর্ডার দিয়ে গেলে উনারা আপনাদের জনসংখ্যা ও চাহিদানুযায়ী খাবার তৈরি করে দিবে। ফিরতি পথে আমরা সোজা হোটেলে খেতে বসলাম। আমাদের মেন্যুতে ছিল ভাত, ডাল, ডিম ও আলু ভর্তা। তৃপ্তিসহকারে খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। খাবারে স্বাদ ছিল মুখে লেগে থাকার মতো।

সন্ধ্যার পরপর আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদিন যেতেই আমি গভীর ঘুমের জগতে হারিয়ে গেলাম। সারাদিনের ভ্রমণক্লান্তিতেসবাই মোটামুটি দূর্বল। ঘুম ভাঙ্গলে দেখতে পেলাম আমরা জ্যামে বসে আছি। আসার সময় যেরকম জ্যাম পেয়েছিলাম এবারও অনেকটা সেরকম। গাড়ির নড়াচড়া টোটালি বন্ধ।

আমার বসার জায়গা একেবারে পিছে হওয়ায় গরমে অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িতে এসি থাকলেও সেটার কার্যকারিতা ছিল ভয়াবহ রকম বাজে। তীব্র গরম আর দীর্ঘ জ্যামে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর মধ্যে চিন্তা হচ্ছিলো আমরা পরদিনের ক্লাস করতে পারবো কিনা। যেহেতু আমরা মাদরাসা থেকে অনুমতি নিয়ে ঘুরতে বের হইনি তাই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে আমাদের সফর সম্পর্কে জানতে পারলে বড়সড় বেগ পোহাতে হতো। জ্যাম দেখে ভয় হচ্ছিলো সকালের ক্লাস নিয়ে।

অবশেষে দীর্ঘ জ্যাম পাড়ি দিয়ে রাত ২ঃ১৭ মিনিটে আমরা মাদরাসার আঙ্গিনায় পৌঁছা‌ই। সেই দেয়াল টপকিয়ে আবার মাদরাসায় প্রবেশ করি।

২৩-০৩-১৮